হঠাৎ করে সে দিন আমার এক বন্ধু আমায় ফোন করে বলছে “আমার ছেলের ছকটা একটু দেখে দেনা”। জিজ্ঞাসা করলাম কেন রে কি হল? বলে “দেখনা এমনই কপালের ফের আমার ছেলের যে ও লেখাপড়ায় খাটাখাটনি করেও তেমন ফল পাচ্ছেনা, ২৪ বছর বয়স হয়ে গেল তেমন কোন চাকরি বাকরি পাচ্ছেনা, কেন? একটু দেখে বলে দেনারে”। কষ্ট লাগলো, সে তো আমার ছোটো বেলাকার বন্ধু। শুধু এ বলে নয়, গ্রহের ফেরে এমন অনেকের একই অবস্থা। কারুর লেখাপড়া, কারুর বিবাহ, কারুর বৈবাহিক জীবন, কারুর রোগভোগ আবার কারুর বা আর্থিক অবস্থা – বর্তমানে এমন ঘটনা বহু পাচ্ছি আমরা। সবই গ্রহের ফেরে এমন ঘটনা ঘটছে। বন্ধুর ছেলের ক্ষেত্রে একই ঘটনা – প্রথমত বন্ধুর ছেলের ছকে চরম কালসর্প দোষ তার সাথে চতুর্থ নবম ও একাদশ ভাবের উপর অশুভ রাহু ও শনির দৃষ্টি। চাকরি ক্ষেত্রেও একই প্রভাব পড়েছে। বন্ধুর ছেলেটি পড়াশুনা নিয়েই পড়ে থাকে কিন্তু তেমন রেজাল্ট করতে পারেনি, চাকরিও ঠিক মত বা মনের মতো বা তার যা যোগ্যতা তেমন চাকরি পাচ্ছেনা। জিজ্ঞাসা করি বন্ধুকে “হ্যাঁরে আগে কখনও কাউকে ছেলের ছকটি দেখিয়েছিলি?” উত্তর “না রে”। খুব কষ্ট হল আমার মনে, কিছুদিন আগে যদি ছকটি কাউকে দেখিয়ে নিতো বা আমাকেও যদি দেখাতো তাহলে বোধহয় এতোটা খারাপ অবস্থা হতোনা। ভাবুনতো লেখাপড়া করেও যদি ভাল ফল না হয় বা কেউ চাকরি না পায় বা তার যোগ্যতা মতন চাকরি না পায় তবে সেই ছেলেরই বা কি অবস্থা হয় বা তার বাবা মায়েরই বা কি অবস্থা হয়। একটু সচেতনার অভাব, গ্রহের ফেরে মানুষের কি অবস্থা। এইযে যোগাযোগটি যে এতোটা দেরীতে হল এটাও গ্রহের ফের।
রাহু ও শনি এই দুটি গ্রহের নাম শুনলেই আমরা কম বেশি সবাই ভয় পাই, এই দুটি গ্রহ মানেই খারাপ কিন্তু না এদের ভালো দিকও আছে। তবে এই দুটি গ্রহের খারাপ দিক কি তা জেনে নেওয়া যাক্। এই দুটি গ্রহের মধ্যে রাহু গ্রহের ফেরে কি হয় তা নিয়ে গল্পের আকারে আগে আলোচনা করি। এক ভদ্রলোক তার ১২ বছরে বয়সে পিতৃ হারা হয়েছিলেন। ভদ্রলোকের পিতা যতদিন বেঁচে ছিলেন ততদিন বিলাস বহুল জীবন যাপ্ন করেছেন। পিতা মারা যাওয়ার পর থেকে তিনি ধীরে ধীরে দারীদ্রতার মধ্যে ডুবে যান। পরর্বতী কালে আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়ালেও তার নিজের মৃত্যুর পর তার সন্তানদেরও তার মতন অবস্থা হয়। জাতকের লগ্নে ছিল রাহু ও শনি – অল্প বয়সে পিতা মাতাকে হারিয়েছেন কিন্তু ভদ্রলোক সাহসী, শৌর্য্যপূর্ণ, সুযুক্তিপূর্ণ, বুদ্ধিমান, আত্মমর্যাদাপূর্ণ। ধনস্থানে বৃহস্পতি ও তৃতীয়ে রবি, মঙ্গল, বুধ ও নেপচুন। ধন স্থানে বৃহস্পতি থাকার জন্য টাকা রোজগার করতে পেরেছেন তবে বেশ কাইক পরিশ্রম করে কিন্তু পরবর্তিকালে আবার ধীরে ধীরে দারীদ্রতার মধ্যে ডুবে যান। তৃতীয়স্থানে রবি, মঙ্গল ও বুধ হওয়ায় জাতক সুযোগসন্ধানি, কর্মঠ, ব্যবসার খাতিরে ভ্রমণ, এক বিধবা বোনের দ্বায়ীত্ব ভার গ্রহণ ইত্যাদী করতে হয়। চতুর্থভাবাধিপতি বুধ তৃতীয়ে ও চতুর্থস্থানে শুক্র অবস্থান করছে। নিজের চেষ্টায় ভদ্রলোক ব্যবসায় উন্নতি কড়েছেন, প্রচুর অর্থ কামিয়েছেন যদিও তিনি কোন পৈত্রিক সম্পত্তি পাননি। চন্দ্র দ্বাদশে, চন্দ্র থেকে চতুর্থে পাপগ্রহ অবস্থান করায় জাতক সৎ মায়ের দ্বারা নানান ভাবে অত্যাচারিত হয়েছেন। পঞ্চমপতি শুক্র পঞ্চম স্থান থেকে দ্বাদশ ভাবে অবস্থান করছে এবং ইউরেনাস অষ্টম ভাবে রয়েছে। জাতক একাধিক মহিলার সাথে সম্বন্ধ যুক্ত ছিলেন, অষ্টমে ইউরেনাস হওয়ায় তার জীবনে মহিলারা জেদী হয়, গোঁয়ার হয়, বশ মানতে চায়না, নাছোড়বান্দা হয়। ভদ্রলোকের জীবনে প্রথম যে মহিলার সাথে বিবাহের ঠিক হয় তার সাথে মতের মিল না হওয়ায় বিবাহ ভেঙ্গে যায়, অপর এক মহিলাকে বিবাহ করেন, কিন্তু ঐ মহিলা বেশি দিন বাঁচেননি ফলে আবার তিনি যাকে প্রথম বিবাহ করতে চেয়েছিলেন তাকে বিবাহ করেন। কিন্তু ব্যবসার জন্য ভদ্রলোকটিকে বছরের বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরে বা দূরে থাকতে হত, তাই তাদের জীবনে সুখ ছিলনা। অষ্টমপতি ও নবমপতি শনি রাহু যুক্ত হয়ে লগ্নে অবস্থান করছে – দুটি বিবাহ হয়েছে, শুধু তাই নয় নিজে শারীরিক অসুস্থতায় ভুগেছে, শরীরে জলের আধিক্য জনিত অসুখে ভোগান্তি ও দারীদ্রতায় দিন কাটিয়েছে ও উভয়ে এক বছর আগে পরে মারা যান। কর্মস্থানাধিপতি বৃহস্পতি ধনস্থানে অবস্থান করায় জাতক বুদ্ধিমান, সৎ চরিত্র, কথাবার্তায় পটু, ধার্মিক, সত্য কথা বলতে ভালোবাসে, জীবনে সাফল্য পরিচিতি সন্মান এসব যে লাভ করেনি তা নয় কিন্তু ভাগ্যের এমনই পরিহাস যে বিভিন্ন ধরনের প্রচেষ্টার মাধ্যমে প্রচুর অর্থ রোজগার করা সত্ত্বেও অর্থ ধরে রাখতে পারেনি। সুখাধিপতি বা লাভাধিপতি মঙ্গল তৃতীয়ে অবস্থান করছে। আবার ব্যায়স্থানাধিপতি শুক্র চতুর্থে ও ব্যায়স্থানে চন্দ্র অবস্থান করছে। প্রচুর অর্থ রোজগার করা সত্ত্বেও দুই বিবাহ হেতু স্ত্রীর সুখার্থে অত্যধিক ব্যায় করেছে এবং অপরকে সাহায্যের জন্য বহু ব্যায়ও করেছে। ব্যায় স্থান দ্বাদশ স্থান থেকে পঞ্চম স্থানের মধ্যে সমস্ত গ্রহগুলি অবস্থান করছে। একটা জিনিস লক্ষ্য করার, তা হল চন্দ্র থেকে দ্বিতীয় স্থানে রাহু শনির অবস্থান, শুক্র থেকে দশমে রাহু শনির অবস্থান, চন্দ্র থেকে তৃতীয় স্থানে বৃহস্পতি ও লগ্ন থেকে দ্বিতীয় স্থানে বৃহস্পতি ও লগ্নে শনি ও রাহুর অবস্থান যা দারীদ্রযোগ নির্দেশ করে। জাতকের প্রথম ও শেষে জীবন খুবই খারাপ কিন্তু মধ্য জীবন তুলনা মূলক ভাবে বেশ ভাল। তাই জাতকের জীবনে যা হয়েছে সবই গ্রহের ফেরে।
গ্রহের ফেরে মানুষ কোথা থেকে কোথায় উঠে যায় দেখা যাক। এক জাতিকার ছকে বৃশ্চিকে লগ্নে শনি, ধনু রাশি, মীনে রবি, শুক্র ও বুধ, মেষে কেতু, বৃষে মঙ্গল, কণ্যায় বৃহস্পতি ও তুলায় রাহু। জাতিকা লেখাপড়ায় খুবই ভাল। এক সময় তিনি সাংবাদিকতায় যুক্ত হন। তাঁর একটা নিজস্ব লেখার ধরন ছিল এবং লেখার সার মর্ম খুব সুন্দর ভাবে ব্যাক্ত করতে পারতেন। জাতিকার বুধ ও শুক্র পঞ্চম ভাবে অবস্থান করছে, তৃতীয় স্থানাধিপতি শনি লগ্নে অবস্থান করছে এবং মঙ্গলকে সপ্তম দৃষ্টি দিচ্ছে। দ্বিতীয় ও পঞ্চম অধিপতি বৃহস্পতি একাদশে সফলতা বা লাভ ভাবে অবস্থান করছে। দ্বিতীয় ও পঞ্চম অধিপতি বৃহস্পতি একাদশে এই যোগটি বেশ ভাল সে অর্থ রোজগারের দিক দিয়ে বলুন বা খ্যাতি, সুনাম, যশের দিক দিয়ে বলুন। আবার দ্বিতীয় ও পঞ্চম অধিপতি বৃহস্পতি একাদশে অবস্থান করে পঞ্চম ভাবের উপ্র দৃষ্টি দান করছে। জাতিকা সাংবাদিকতা জীবনে যেমন খ্যাতি, সুনাম, যশ লাভ করেছে তেমন এই পেশায় প্রচুর অর্থ উপার্যন করেছে। এখানে শুক্র গ্রহের মহিমাই বড়। ঠিক এর উল্টোটাও দেখুন। ইনিও একজন সাংবাদিক হয়েও সাংবাদিকতার জীবনে তেমন ভাবে কৃতকার্য্য হতে পারেনি। এর জন্মছকে ধনুতে লগ্ন, দ্বিতীয় – ধন ভাবে শণি, তৃতীয়ভাবে রাহু, নবম ভাবে চন্দ্র ও কেতু, দশম ভাবে রবি, বুধ, বৃহস্পতি ও একাদশ ভাবে মঙ্গল ও শুক্র। দ্বিতীয় ও তৃতীয়পতি শনি এবং পঞ্চম পতি মঙ্গল একে অপরকে দৃষ্টি দিচ্ছে। পঞ্চমাধিপতি মঙ্গল একাদশে অবস্থান করে পঞ্চম ভাবকে দৃষ্টি দিচ্ছে। এই পর্যন্ত ঠিক আছে, কিন্তু রাহু তৃতীয়ে আবস্থান করে পঞ্চম পতি মঙ্গল ও ষষ্টপতি শুক্রকে একাদশে পঞ্চম দৃষ্টিতে আবদ্ধ করেছে যা বিনাশক বা ধংসাত্মক নির্দেশ করে। ভাল যোগ থাকা সত্ত্বেও খারাপ দৃষ্টির জন্য জাতিকা তার সাংবাদিকতার জীবনে তেমন ভাবে কোন উন্নতি করতে পারলোনা। এটাও কিন্তু গ্রহের দৃষ্টির কুফল। তাই গ্রহের ফেরে কারুর পৌষ মাস কারুর সর্বনাশ। হা ভগবান সবই অদৃষ্টের খেলা।